
-
Facebook
-
Twitter
-
Linkedin
পুরান ঢাকার পথে প্রান্তরে হাজারো ভবঘুরে ও পথশিশুর বাস
পুরান ঢাকা, যেখানে প্রতিটি ইট-পাথরে লেখা আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সেখানেই বেঁচে থাকার লড়াই করছেন হাজারো ভবঘুরে ও পথশিশু। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী পুরান ঢাকায় দেখা মিলে ২ হাজারের অধিক ভবঘুরে ও পথশিশুর।
সরেজমিনে পুরান ঢাকা, সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার, বাহদুর শাহ পার্ক, শ্যামবাজার ঘুরে দেখা যায়, ফুটপাথই যেন তাদের বাড়িঘর। বেঁচে থাকার তাগিদে অনিশ্চয়তায় কাটছে তাদের জীবন। তাদের কেউ টুকটাক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও অধিকাংশই ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি ও নেশায় আসক্ত।
পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কে প্রায় ২ বছর ধরে কুসুমের (১০) বসবাস। কুসুম সময়ের আলোকে বলেন, ছোট বেলায় মা মারা যায়। বাবা নতুন বিয়ে করলে আমারে নানির কাছে পাঠায়। নানি মারা যাওয়ার পর এটাই আমার ঠিকানা।
এখানে যে থাকো খাবার দেয় কে? জানতে চাইলে কুসুম বলেন, এখানে যারা ঘুরতে আসে তাদের থেকে চাই। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। আবার মাঝে মাঝে কলম বিক্রি করি যা পাই তাই দিয়ে খাওয়া দাওয়া করে দিন কাটে। মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকি। আর রাতে এই পার্কেই ঘুমাই।
কাগজের মোড়কের মধ্যে মুখ গুজে গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছে রাফিন (ছদ্ম নাম)। বয়স জানা নেই, তবে আনুমানিক ১৩ বছর। কাছে যেতেই হকচকিয়ে যায়। এগুলো কি? জানতে চাইলে রাফিন বলেন ‘ড্যান্ডি’ খাই। (ড্যান্ডি হচ্ছে এক ধরনের আঠা বা গাম। যা জুতা বা সাইকেলের টায়ারে ব্যবহার করা হয়)।
এটা খাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলে, এটা খেলে নেশা হয়। নেশা করলে খুদা লাগেনা। আমার কাছে টাকা থাকলে আমি এই গাম না খেয়ে ভাত খাইতাম। ৪০-৫০ টাকার গাম কিনলে তিন দিন খাইতে পারুম। এই তিন দিন এক বেলা খাইলেও চলে। কিন্তু এই ৫০ টাকা দিয়া কি তিন বেলাত ভাত খাওন যাইবো?’
ফুল বিক্রি করছিল প্রতিবন্ধী নাজমা (১১)। কারও কাছে হাত না পেতে নিজের পরিশ্রমের বিনিময়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, মাঝে মাঝে মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে। তাও নিজে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক পথচারী বলেন, মেয়েটা প্রতিবন্ধী হলেও হাত পাততে দেখা যায় না খুব একটা। মাঝে মাঝে আমরা নিজে থেকে তাকে খাবার কিনে দেই।
পুরান ঢাকার ধুপখোলা মাঠে দেখা যায় এক করুণ চিত্র। শরিয়তপুর জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা হারুনর রশীদ। বয়স ৭০/৮০, সপরিবারে থাকতেন পদ্মার তীরবর্তী একটি গ্রামে। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে যায় তার ঘর-বাড়ি, হারিয়ে ফেলেন তার স্ত্রী ও সন্তানদের। আশ্রয়ের খোঁজে সদরঘাটে আসেন। তারপর ঘুরতে ঘুরতে এখানে। তিনি বলেন, আগে কিছু কিছু কাজ করলেও এখন পারি না। আশেপাশের মানুষ যা দেয় তাই খেয়ে বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকি।
মাঠের সিঁড়িতে প্রতিদিনই দেখা যায় এক অসহায় নারীকে, যিনি ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেন। স্থানীয়দের মতে, এই নারী দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকায় ভিক্ষা করে আসছেন। কেউ তাকে সাহায্য করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, কিন্তু দুঃখের কথা বলতে চান না। তার অতীত নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তার সাথে কথা বলতে চাইলে, অস্বীকৃতি জানান।
তাসনিয়া (১৭) নামের এক কিশোরী বছর দুয়েক আগে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছে এই সদরঘাটে। শিশু ছেলেকে নিয়ে এখন ভিক্ষা করে জীবন পার করছে সে। অর্ধযুগ ধরেই এখানে তার বসবাস। সেও ছেঁড়া একটা কাপড় দিয়ে কোনোরকমে ছেলেকে নিয়ে শুয়ে ছিলো লঞ্চ টার্মিনালের গেটে।
কথায় কথায় জানায়, আগে তো বোতল কুড়িয়ে টুকটাক কাজ করতে পারতাম। এখন সন্তানের জন্য কোথাও যেতে পারি না, তাই মানুষের কাছে হাত পাতি। সন্তানের বাবার কথা জানতে চাইলে এড়িয়ে যান তিনি।
ছালমা খাতুনকে (৪৫) দেখা যায়, পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে ব্যবসায়ীদের ফেলা দেওয়া উচ্ছিষ্ট পণ্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, ভিক্ষার থেকে না খেয়ে থাকা অনেক ভালো। এগুলো বিক্রি করেই সংসার চালাই। এক ছেলে আছে প্রতিবন্ধী আর কেউ নেই। ছেলেকে নিয়েই আশে পাশে যখন যেখানে যায়গা পাই সেখানেই রাত কাটাই।
সদরঘাটে বেড়ে ওঠা পঁচিশ বছরের রফিক জানেন না তার বাবা-মায়ের পরিচয়। শৈশব থেকেই এই লঞ্চ টার্মিনালে কাটাচ্ছেন তিনি। রফিক জানায়, ছোটবেলায় কিভাবে এখানে এসেছি মনে নেই। আগে মানুষের থেকে চেয়ে খাইতাম। মাঝে মাঝে চুরিও করতাম। ক্ষুধার জ্বালায় একদিন এক নারীর ব্যাগ নিয়ে দৌড়া দিয়েছিল সে। সেকথাও প্রতিবেদকের কাছে অকপটে স্বীকার করেন তিনি। পরে ধরা পড়লে মারও খেয়েছে সে। আরও বলেন, এখন আর এইসব করি না, এই যে দেখেন বোতল, প্লাস্টিক এগুলো টোকাই। আর মাঝে মাঝে লঞ্চে কুলির কাজ করি।
এমন হাজারো ভবঘুরে ও পথশিশু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যাদের পরিচয় নেই, আশ্রয় নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটা রাষ্ট্র যখন কল্যাণমূলক হয়ে ওঠে, তখন তার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করা। খাদ্যের সংস্থান করা, এটা একটা মৌলিক চাহিদার মধ্যে পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এটা পূরণ করা। সব ভবঘুরে ও পথশিশুদের একটা প্লাটফর্মে নিয়ে আসা দরকার। এই জায়গাটাতে রাষ্ট্রের প্রচুর ভূমিকা রয়েছে, সেই ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে সিস্টেমেটিক কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো যদি সমাধান করা যায় এবং দুর্নীতি দূর করা যায়; তাহলে ভবঘুরে ও পথশিশুরা ভালো থাকবে।
সময়ের আলো অনলাইন/২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
আরও - ভিন্ন খবর
রমজানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
রবিবার থেকে বাড়ছে মাংস, ডিম ও দুধ বিক্রি কার্যক্রমের পরিধি
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে