সেই ২০০০ সাল থেকে স্বচ্ছতার সাথে পথচলা...

প্রশাসনে ১৪ সচিবসহ রেকর্ড সংখ্যক কর্মকর্তা ওএসডি

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের ওএসডি করার পাশাপাশি অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও অবসরে যাওয়াদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে তিনজন সিনিয়র সচিব, ৯ জন সচিব এবং সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১ পদের দুজনসহ ৫৫০ জন কর্মকর্তা ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) রয়েছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে ওএসডি করা কর্মকর্তার সংখ্যা দেড় শতাধিক। আর ছুটি ও প্রেষণের কারণে ২৫০ জন এবং পদোন্নতির কারণে ওএসডি ১৪৫ জন। এ ছাড়া সরকার পরিবর্তনের পর ১৭ জন সচিব ও গ্রেড-১ কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের শতাধিক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনিক কারণে ওএসডি ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর এই সংখ্যা রেকর্ড। তা ছাড়া এর আগে কখনো এত বেশি সংখ্যক সচিবকে ওএসডি রাখা হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ২৫০ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি ছিল প্রায় ১০০ জন। তবে সবচেয়ে কম ওএসডি ছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মাত্র ৫৮ জন। বর্তমানে প্রশাসনে সহকারী সচিব থেকে সচিব ও সিনিয়র সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে মোট কর্মরত ৬ হাজার ৫৬০ জন কর্মকর্তার মধ্যে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওএসডি) সংখ্যা ৫৫০ জন।

এর মধ্যে রয়েছেন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ১৪ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৩৬ জন, যুগ্ম সচিব পদে ১৫৮ জন, উপসচিব পদে ১১৭ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ১৪৪ জন ও সহকারী সচিব পদের ৮৮। আওয়ামী লীগের সময়ে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রাথমিকভাবে ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৪৩ জনকে ওএসডি এবং যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরেরও বেশি এমন ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ওএসডির তালিকা আরও লম্বা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার এ পর্যন্ত ১৭ জন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১ কর্মকর্তাসহ ২৯ জন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্ম সচিব এবং একজন উপসচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য সাবেক জেলা প্রশাসকদের মধ্যে কাউকে ওএসডি, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন অনিয়ম ও বিতর্কিত ভূমিকা পালন করার কারণেও কেউ কেউ ওএসডি হয়েছেন। তিনি বলেন, ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের কোনো পক্ষপাত নেই। পক্ষপাতমূলকভাবে বা কোনো কিছুর বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। সব সিদ্ধান্ত হবে নিয়মনীতির মধ্যে থেকে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সিনিয়র সচিব, সচিব ও সমমর্যাদার পদে কর্মকর্তা রয়েছেন ৯৬ জন। এর মধ্যে ওএসডি আছেন ১৪ জন। ওএসডি সিনিয়র সচিবদের মধ্যে রয়েছেন মো. মোস্তফা কামাল, মো. মশিউর রহমান ও মো. মনজুর হোসেন। সচিব হিসেবে ওএসডি আছেন মো. সামসুল আরেফিন, মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, মো. আজিজুর রহমান, মো. নুরুল আলম, মো. খায়রুল আলম শেখ, ফরিদ উদ্দিন আহমদ, রেহানা পারভীন, শফিউল আজিম এবং একেএম মতিউর রহমান।

অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিবসহ সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১৭ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে রয়েছেন। এর আগে শীর্ষ পদে একসঙ্গে এত সংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোনো কাজ না করেও ওএসডি থাকা এসব কর্মকর্তার বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে মাসে সরকারের কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়। তবে শুধু যে শাস্তি হিসেবে ওএসডি করা হয় এমনটা নয়। চাকরির পদোন্নতির পর নতুন পদায়নের আগে অথবা এলপিআরে যাওয়ার আগেও ওএসডি করা হয়। ওএসডি কর্মকর্তারা বেতন-ভাতা ও গাড়িসহ সব ধরনের সরকারি সুবিধাই পেয়ে থাকেন। শুধু কোনো দায়িত্ব থাকে না। তাই তাদের অফিসের নির্দিষ্ট সময়ে সচিবালয়ে এসে হাজিরা দিতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে রাখা হাজিরা খাতায়। বলা যায়, লাইব্রেরিই তাদের অফিস কক্ষ। ওএসডি থাকা একাধিক কর্মকর্তার দাবি, প্রশাসনে কিছু সময়ের জন্য ওএসডি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও সরকারের আস্থাভাজন হতে না পারাই ওএসডি হওয়ার প্রধান কারণ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় বা বিগত সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার কারণে দেড় শতাধিক কর্মকর্তাকে ওএসডি এবং শতাধিক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনের আড়াইশ কর্মকর্তাকে ও এসডি ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি।

কর্মকর্তারা জানান, প্রশাসনে দীর্ঘ সময় ধরে ওএসডি থাকায় তাদের জীবনে দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করে। পদ থাকার পরও কোনো দায়িত্ব না থাকায় তারা বিষয়টিকে শাস্তি হিসেবে মনে করেন। তা ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ কত দিন ওএসডি রাখা যাবে, তার কোনো বিধান না থাকায় বছরের পর বছর এই দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হবে অনেককে। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলের সচিবদের ওএসডি ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পাশাপাশি গ্রেফতারও করা হয়েছে কয়েকজনকে। এসব কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে ওএসডি হওয়া এবং যাদের চাকরি ২৫ বছর হতে যাচ্ছে তাদের মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর আতঙ্ক কাজ করছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, একজন অতিরিক্ত সচিবের মূল বেতন ৬৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ৩৩ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, দেড় হাজার টাকা মোবাইল ফোন বিল, দেড় হাজার টাকা মেডিকেল ভাতা, ৯০০ টাকা আপ্যায়ন ভাতাএবং ৫০ হাজার টাকা গাড়ির খরচ বাবদ পেয়ে থাকেন। সবমিলিয়ে একজন অতিরিক্ত সচিবের পেছনে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা। আর একজন সচিবের পেছনে খরচ হয় ২ লাখ টাকারও বেশি। এ ছাড়া একজন যুগ্ম সচিবের বেতন স্কেল শুরুতে ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া, গাড়ি (মেরামত খরচসহ ৫০ হাজার টাকা), টেলিফোন বিল, আপ্যায়ন ও মেডিকেল ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার পেছনে মাসে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। ৫০ হাজার টাকা বেতন স্কেলে একজন উপ-সচিব বেতন-ভাতাসহ মাসে পেয়ে থাকেন কমপক্ষে ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা বেতন স্কেলে সিনিয়র সহকারী সচিবরা মাসে বেতন-ভাতা মিলিয়ে পান ৫৪ হাজার ২৫০ টাকা। আর ২৯ হাজার টাকা বেতন স্কেলে সহকারী সচিবরা বেতন-ভাতা মিলিয়ে মাসে পান ৪৫ হাজার টাকা। ফলে ওএসডি থাকা কর্মকর্তারা কাজ না করেও বসে বসে বেতন পাচ্ছেন যা সরকারের জন্য অপচয়।

সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, বিগত সরকারের সময়ে যদি নিয়মকানুন না মেনে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি ও পদায়ন দিত তা হলে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এ কারণে সরকার পরিবর্তনের পর একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় প্রশাসনে ওএসডির সংখ্যাটা বেড়েছে। তবে ওএসডি ব্যবস্থায় মূলত কোনো কাজ করানো ছাড়াই বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে হচ্ছে সরকারকে। এই ব্যয় এক ধরনের অপচয়ের শামিল। এটি আর্থিক এবং নৈতিক সবদিক থেকেই নেতিবাচক। এর কোনো ইতিবাচক দিক নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক বলেন, বর্তমানে প্রশাসনিক কারণে ওএসডি অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি বলে আমার মনে হয় না। আর তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও তা কী কারণে তা বলতে পারব না। তিনি বলেন, প্রশাসনে ওএসডি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রশাসনিক কারণ ছাড়াও পদোন্নতি, প্রেষণ এবং প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কারণে ওএসডি হয়। চাকরির পদোন্নতির পর নতুন পদায়নের আগে অথবা এলপিআর এ যাওয়ার আগেও ওএসডি করা হয়।

রফিকুল ইসলাম সবুজ
সময়ের আলো ডেস্ক/১৬ এপ্রিল, ২০২৫

আরও - জাতীয় সংবাদ

আরও - জেলা সংবাদ