-
Facebook
-
Twitter
-
Linkedin
২৩৭ আসনে প্রার্থী দিল বিএনপি
টানা কয়েক মাস মাঠ জরিপ ও বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন শেষে দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বিএনপি। আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করল দলটি। অভিজ্ঞ ও পুরোনোদের ওপরই ভরসা রেখেছে বিএনপি। তালিকার বেশিরভাগ ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। বাকি ৬৩ আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগ যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা পেতে পারেন। কারাগারে থাকায় সবশেষ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও এবার তিনটি আসনে ভোট করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর জীবনের প্রথমবারের মতো ভোট করবেন তারই পুত্র দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সোমবার সন্ধ্যায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেন। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে দুপুর সাড়ে ১২টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভায় সভাপতিত্ব করেন। টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপি মহাসচিব। সঙ্গে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।
তিন আসনে লড়বেন খালেদা জিয়া ও বগুড়ায় তারেক রহমান : ঘোষিত তালিকায় দিনাজপুর-৩, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনেও নির্বাচন করেছেন; কখনো হারেননি। খালেদা জিয়ার পৈতৃক আদি নিবাস ফেনীতে। আর তার স্বামী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৈতৃক বাড়ি বগুড়ায়। খালেদা জিয়ার জন্ম, শৈশব ও পড়াশোনা দিনাজপুর শহরে হলেও এর আগে তিনি কখনো এখান থেকে প্রার্থী হননি।
দিনাজপুর-৩ আসন থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশীদ জাহান হক প্রার্থী হন। বগুড়া-৬ : প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়া ‘বিএনপির ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। খালেদা জিয়া সেই ১৯৯১ সাল থেকে শ্বশুরবাড়ি বগুড়ার দুটি আসনে নির্বাচন করে আসছেন। বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাহজাহানপুর) আসনে তিনি কখনো পরাজয়ের মুখ দেখেননি। বগুড়া-৭ সংসদীয় আসনে বিগত ১২টি নির্বাচনে বিএনপি ছয়বার (এর মধ্যে খালেদা জিয়া পাঁচবার), জাতীয় পার্টি তিনবার, আওয়ামী লীগ দুবার এবং স্বতস্ত্র (বিএনপির সমর্থনে) প্রার্থী একবার জয় পেয়েছেন।
প্রায় দুই দশক ধরে দল ও নির্বাচন পরিচালনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও তিনি কখনো সরাসরি ভোটের মাঠে প্রার্থী হননি; তবে এবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসনে ভোট করবেন।
বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৪ জনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে মহাসচিবসহ ১০ জনের নাম রয়েছে। তারা হলেনÑঠাকুরগাঁও-১ আসনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কুমিল্লা-১ আসনে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ঢাকা-৮ আসনে মির্জা আব্বাস, ঢাকা-৩ আসনে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নরসিংদী-২ আসনে আবদুল মঈন খান, চট্টগ্রাম-১০ আসনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কক্সবাজার-১ আসনে সালাহউদ্দিন আহমেদ, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভোলা-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও দিনাজপুর-৬ আসনে এজেডএম জাহিদ হোসেন। নির্বাচন করছেন না স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার। তার আসনে ব্যারিস্টার নওশাদ জমিরকে প্রার্থী করা হয়েছে। একাদশ নির্বাচনের মতো স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবারও নির্বাচন থেকে বিরত আছেন। এ ছাড়া বেগম সেলিমা রহমান ও অসুস্থ ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াও নির্বাচন করছেন না। দলে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানও ভোট করছেন না।
ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে পটুয়াখালী-১ আসনে আলতাফ হোসেন চৌধুরী, নোয়াখালী-৩ আসনে বরকত উল্লাহ বুলু, নোয়াখালী-৪ আসনে মোহাম্মদ শাহজাহান, ফেনী-৩ আসনে আবদুল আউয়াল মিন্টু, মাগুরা-২ আসনে নিতাই রায় চৌধুরী, কুমিল্লা-৩ আসনে কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, টাঙ্গাইল-৮ আসনে আহমেদ আজম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে কুমিল্লা-৬ আসনে মনিরুল হক চৌধুরী, ঢাকা-২ আসনে আমান উল্লাহ আমান, নোয়াখালী-১ আসনে মাহবুব উদ্দিন খোকন, নোয়াখালী-৪ আসনে জয়নুল আবদিন ফারুক, বরিশাল-১ আসনে জহির উদ্দিন স্বপন, বরিশাল-৫ আসনে মজিবুর রহমান সারোয়ার, নেত্রকোনা-৪ আসনে লুৎফুজ্জামান বাবর, কুড়িগ্রাম-৩ আসনে তাজভীর উল ইসলাম, পাবনা-৪ আসনে হাবিবুর রহমান হাবিব, ব্রাক্ষণবাড়িয়া-৪ আসনে মুশফিকুর রহমান, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, মানিকগঞ্জ-২ আসনে মঈনুল ইসলাম খান, সিলেট-১ আসনে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, সিলেট-২ আসনে তাহমিনা রশদীর লুনা, লক্ষ্মীপুর-২ আসনে আবুল খায়ের ভূঁইয়া, সিলেট-৬ আসনে এনামুল হক চৌধুরী, টাঙ্গাইল-২ আসনে আবদুস সালাম পিন্টু, ফেনী-২ আসনে জয়নাল আবেদীন ভিপি জয়নাল, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে ফজলুর রহমান, মৌলভীবাজার-৩ আসনে নাসের রহমান রয়েছেন।
যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যেÑনরসিংদী-১ আসনে খায়রুল কবির খোকন এবং লক্ষ্মীপুর-২ আসনে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এবং ময়মনসিংহ-১ আসনে সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স রয়েছেন।এবারেরর নির্বাচনে ঘোষিত ২৩৭ আসনে একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাদের অনেকেই ছিলেন আলোচনায়। শেষ পর্যন্ত তালিকায় ঠাঁই হয়নি।
প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে ২৩৭ আসনে আমরা সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলাম। এরপরে আমাদের সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা আসতে পারেন। অথবা আমাদের আসনও আমরা পরিবর্তন করতে পারি এটা আমরা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা বলতে চাই, এটা আমাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, এজেডএম জাহিদ হোসেনসহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকায় চমক সানজিদা তুলি ও যশোরে শ্রাবণ : এবারের নির্বাচনে ঢাকা-১৪ আসনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলামকে তুলিকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে নিয়ে এ সংগঠন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সানজিদা ইসলাম। তার ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমন ছিলেন ২৫ নম্বর ওয়ার্ড (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় র্যাবের একটি দল। এখনও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ঢাকা-১৪ আসনের বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী ছিলেন এস এ সিদ্দিক সাজু। তিনি ২০১৮ সালে মনোনয়নও পেয়েছিলেন। বিএনপির কয়েকবারের সাবেক এমপি এস এ খালেকের ছেলে তিনি। এই আসনে তুলিকে প্রার্থী করে চমক দিয়েছে বিএনপি।
এ ছাড়া যশোর-৬ আসনে (কেশবপুর উপজেলা) ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করবেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। তিনি বর্তমানে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি বয়সে অন্যদের থেকে অনেকটাই তরুণ।
খুলনা-২ আসন থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর আবারও রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসা বড় ধরনের ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর খুলনা বিএনপির রাজনীতির পুরোনো মুখ হিসেবে তিনি আলোচনায় ফিরলেন। দলের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনের জেরে তার পদ স্থগিত করা হয়।
কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম) আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির সিনিয়র নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান। বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে গত ২৬ আগস্ট তিন মাসের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমানের পদ স্থগিত করে।
তালিকায় আছে ১২ আসনে ১০ নারীর নাম : প্রার্থী তালিকার মধ্যে কেবল খালেদা জিয়ার জন্য তিনটি আসন ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাইরে আর যেসব নারী নেত্রীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন সানজিদা ইসলাম তুলি (ঢাকা-১৪), আফরোজা খানম রিতা (মানিকগঞ্জ-৩), তাহসিনা রুশদীর লুনা (সিলেট-২), শামা ওবায়েদ (ফরিদপুর-২), চৌধুরী নায়াব ইউসুফ (ফরিদপুর-৩), ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো (ঝালকাঠি-২), ফারজানা শারমিন পুতুল (নাটোর-১), সানসিলা জেবরিন প্রিয়াংকা (শেরপুর-১) ও সাবিরা সুলতানা মুন্নী (যশোর-২)।
তালিকায় ঠাঁই হয়নি শিল্পী ও সাংবাদিকদের : বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন সাংবাদিক এবং বিনোদন অঙ্গনের তারকারাও। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে তাদের নামও শোনা গিয়েছিল এতদিন ধরে। গণসংযোগও করেছেন তারা। তবে কোথাও নেই কোনো সাংবাদিক ও তারকার নাম।
অন্যদিকে কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন, মনির খান, রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা ও অভিনেতা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বলের নামও ছিল আলোচনায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় উঠে এসেছে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর, নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি, চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী হেলাল খান ও শিবা সানু বিএনপির হয়ে নির্বাচনে লড়তে পারেন। এ ছাড়া সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম ছিল আমিরুল ইসলাম কাগজী, আনোয়ার আলদ্বীন, কাদের গণি চৌধুরী, এম এ আজিজ ও সাঈদ খানের নাম।
এর আগে ২০১৮ সালে নীলফামারী-৪ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন বেবী নাজনীন। এবার এ সংগীতশিল্পীর এলাকা থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মো. আব্দুল গফুর সরকার।
২০১৮ সালে সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কনকচাঁপা; কিন্তু এবার সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে এখনও কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। মনির খানের ঝিনাইদহ-৩ আসন থেকে মোহাম্মদ মেহেদী হাসান মনোনয়ন পান।
সময়ের আলো/৪ নভেম্বর, ২০২৫