সেই ২০০০ সাল থেকে স্বচ্ছতার সাথে পথচলা...

প্রেমিকাকে নিয়ে হাসাহাসি করায় হত্যার পরিকল্পনা করে পিয়াস

প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে র‌্যানকন ভবনের সামনে ‘আলামিনের দোকান’ নামে পরিচিত একটি চা দোকানের সামনে জাহিদুল ইসলাম পারভেজ তার বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুই ছাত্রী। তাদের একজন প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবু জর গিফারি ওরফে পিয়াসের প্রেমিকা। মোবাইল ফোনে প্রেমিকার কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে বন্ধুদের নিয়ে আলামিনের দোকানের সামনে ছুটে আসেন পিয়াস। এক পর্যায়ে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। কারণ পিয়াস জুনিয়র হওয়ার পরেও পারভেজদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছিল। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাধান করে দেওয়ার পরেও তুষ্ট হতে পারেননি পিয়াস। পারভেজকে হত্যার পরিকল্পনা করে পিয়াস। সেটি বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের ও এর বাইরের সহপাঠীদের নিয়ে পারভেজ ও তার বন্ধুদের ওপর হামলা করে। এ সময় ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে মারা যান পারভেজ। আর হামলাকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

বনানী থানা সূত্র জানায়, ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুই ছাত্রীকে খুঁজছে পুলিশ। ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, ওই দুই ছাত্রীর মধ্যে একজন পিয়াসের প্রেমিকা। আর প্রথম যে তিনজনের সঙ্গে পারভেজদের বাকবিতণ্ডা হয় সেখানেও ছিল পিয়াস। আসামিদের মধ্যে পিয়াস ছাড়াও আরও একজন প্রেমিক থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে ওই ছাত্রীদের খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ ও আসামিরা গ্রেফতার হলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এ ঘটনায় আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ জনের বিরুদ্ধে বনানী থানায় হত্যা মামলা করেছেন নিহত পারভেজের চাচাতো ভাই হুমায়ুন কবির। মামলার আসামিরা হলেন- মেহরাজ ইসলাম (২০), আবু জর গিফারি ওরফে পিয়াস (২০), মো. মাহাথির হাসান (২০), সোবহান নিয়াজ তুষার (২৪), হৃদয় মিয়াজী (২৩), রিফাত (২১), আলী (২১) ও ফাহিম (২২)। মামলার এজাহারে বলা হয়, তুষার ও হৃদয় রাজধানীর বনানীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা। তারা পিয়াসের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ছিল বলে জানা গেছে।

বৈষম্যবিরোধীদের দায়ী করল ছাত্রদল: রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, পারভেজকে হত্যার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জড়িত। তুচ্ছ একটি ঘটনার জেরে একজন মেধাবী ছাত্রকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নয়াপল্টনে বিক্ষোভ মিছিলও করেছে সংগঠনটি। অন্যদিকে রাকিবুলের এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফেসবুক পেজে দেওয়া প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলেছে, একজন মৃত ব্যক্তির মরদেহের ওপর দাঁড়িয়ে ছাত্রদলের এমন ঘৃণ্য মিথ্যাচারের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সোবহান নিয়াজ তুষার এবং হৃদয় মিয়াজী পারভেজ হত্যার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন।

সংবাদ সম্মেলনে রাকিবুল বলেন, পারভেজের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড পেজ থেকে অশোভনীয় ভাষায় পোস্ট দেওয়া হয়েছে। বনানী থানায় দায়ের হওয়া মামলার তথ্য জানিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেন, মামলার বাকি আসামিরা হলেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী থানা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সোবহান নিয়াজ (তুষার), যুগ্ম সদস্য সচিব হৃদয় মিয়াজী, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির অন্য দুই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা আবু জর গিফারি ও মাহাদী হাসান। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এসব নেতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদ: রাকিবুলের এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুক পেজে দেওয়া প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলেছে, পারভেজকে হত্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বনানী থানার যুগ্ম আহ্বায়ক সোবহান নিয়াজ তুষার ও যুগ্ম সদস্য সচিব হৃদয় মিয়াজীকে দায়ী করেছে ছাত্রদল। একজন মৃত ব্যক্তির মরদেহের ওপর দাঁড়িয়ে ছাত্রদলের এমন ঘৃণ্য মিথ্যাচারের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সোবহান নিয়াজ তুষার এবং হৃদয় মিয়াজী পারভেজ হত্যার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘পুসাব’ তাদের ফেসবুকে যে তিনজন হত্যাকারীর নাম উল্লেখ করেছে, সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উল্লিখিত দুজন নেতা অন্তর্ভুক্ত নন। দেশের সব প্রথম সারির মিডিয়াতে পারভেজ হত্যার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও কোথাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো নেতাকর্মীর বিন্দুমাত্র অভিযোগের কথা বলা হয়নি। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেখানেও সোবহান নিয়াজ তুষার এবং হৃদয় মিয়াজীর কোনো উপস্থিতি ও হত্যার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়নি।

প্রতিবাদে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছাত্রদল কর্মীরা যাচাই-বাছাই না করে ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম জড়াচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কেউ একটি প্রমাণও দিতে পারেননি। প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত কোনো ব্যক্তির বরাতেও তুষার ও হৃদয়ের কথা পাওয়া যায়নি।

একই সঙ্গে পারভেজ হত্যার মূল আসামিরা অনালোচিত থেকে যাচ্ছে। পারভেজ ছাত্রদল কর্মী হলেও ছাত্রদলেরই সাধারণ সম্পাদক হত্যাকারীদের কেন আড়াল করতে চাইছেন সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। হত্যাকারীদের আড়াল করতে চাওয়ার পেছনে তার অন্য কোনো দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য আছে কি না সেটি গোয়েন্দা বাহিনীকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। সর্বোপরি ছাত্রদলকে অনুরোধ জানাব নিজ দলের কর্মীদের মরদেহ ব্যবহার করে নোংরামির রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে।

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে: এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত শনিবার বেলা ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে র‌্যানকন ভবনের সামনে স্থানীয়ভাবে আলামিনের দোকান নামে পরিচিত একটি দোকানের সামনে পারভেজ তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলেন ও হাসছিলেন। তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুই ছাত্রী। এ সময় মাহাথির, মেহরাজ ও আবু জর পারভেজের কাছে গিয়ে জানতে চান, তারা হাসছেন কেন। এ নিয়ে পারভেজ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের কথাকাটাকাটি হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক এসে পরিস্থিতি সামাল দেন এবং বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে পারভেজ ও তার বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় কথা বলছিলেন, তখন মামলার আসামিরা কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে তাদের ধাওয়া করে। এতে বলা হয়, পারভেজ ও তার বন্ধুরা দৌড়ে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে মেহরাজ, আবু জর, মাহাথি ও রিফাত বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পারভেজ ও তার বন্ধু তারিকুল ইসলামকে ধরে ফেলেন। এরপর আসামিরা অজ্ঞাত সহযোগীদের সঙ্গে মিলে দুজনকে নির্মমভাবে মারধর করে। মামলার নথিতে বলা হয়েছে, আবু জর ও মাহাথি পারভেজকে শক্ত করে ধরে রাখে এবং মেহরাজ ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আঘাত করে। এ ছাড়াও তারা তারিকুল ইসলামের ওপরও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে তার মাথার মাঝখানে এবং বাঁ হাতের কনুইয়ের নিচে গুরুতর জখম করে।

হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে নিহত পারভেজের মামাতো ভাই ও মামলার বাদী হুমায়ুন কবির বলেন, আমার ভাই শান্ত স্বভাবের ছিল। কোনো মারামারির মধ্যে ছিল না। কেন তাকে হত্যা করা হলো বুঝতে পারছি না। এই হত্যার বিচার চাই। হুমায়ুন আরও বলেন, এক ভাই, এক বোনের মধ্যে পারভেজ ছিল বড়। ছোট বোন ঢাকা মাইলস্টোনে পড়াশোনা করে। বাবা জসিম উদ্দিন কুয়েত প্রবাসী। মা পারভীন আক্তার গৃহিণী। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ফাই চান গ্রামে। বর্তমানে পারভেজ কাফরুল কাজীপাড়া আল হেরা হাসপাতালের পাশে একটি মেসে থাকত। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল পারভেজ। এদিকে পারভেজ হত্যায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ। সংগঠনটি বলছে, তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে পারভেজকে যেভাবে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশের উচিত কালবিলম্ব না করে অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো।

চিরনিদ্রায় শায়িত পারভেজ: ঢামেক সূত্র জানায়, গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে ঢামেক মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় পারভেজের। ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক প্রভাষক ডা. ফারহানা ইয়াসমিন। এর আগে মরদেহের সুরতহাল সম্পন্ন করেন বনানী থানার উপ-পরিদর্শক মওদুদ কামাল। তিনি সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করেন, শনিবার বিকালে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। পারভেজের বুকের বাম পাশে একটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পারভেজের স্বজনরা জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পারভেজের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর মরদেহ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকায় নেওয়া হয়। সেখানে তৃতীয় জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করা হয়।

হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা বলছে পুলিশ: ডিএমপির গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আল আমিন হোসাইন সময়ের আলোকে বলেন, দুই নারী শিক্ষার্থীকে দেখে হাসাহাসির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আমরা পূর্ব শত্রুতা বা রাজনৈতিক বিরোধের মতো কোনো কারণ পাইনি। বনানী থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) একেএম মঈনউদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, পারভেজ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা করা হয়েছে। এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি এবং আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত দুই নারীকে ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

ইমরান রহমান
সময়ের আলো/২১ এপ্রিল, ২০২৫

আরও - জাতীয় সংবাদ