
-
Facebook
-
Twitter
-
Linkedin
ওয়াকফ আইন বাতিলে ঐতিহাসিক আন্দোলনের ডাক দিলেন ওয়াইসি
ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের ধর্মীয় সম্পত্তি সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো ওয়াকফ। কিন্তু সদ্য প্রস্তাবিত “ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫” নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক ও উদ্বেগ। এই আইন বাতিলের দাবিতে সরব হয়েছেন সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। তিনি এক বিশাল জনসভায় জানিয়েছেন, কৃষক আন্দোলনের পথ অনুসরণ করে এবার শুরু হবে দীর্ঘমেয়াদি আইনি ও সামাজিক আন্দোলন।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) হায়দরাবাদের দারুসসালাম-এ অনুষ্ঠিত সভায় আসাদুদ্দিন ওয়াইসি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিশানা করে বলেন, “তিনি বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের পায়ের ধুলোরও যোগ্য নন।” ওয়াইসির অভিযোগ, নতুন এই সংশোধনী আইন কার্যকর হওয়ার মাত্র এক মাসের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশে প্রায় ৫০০টি ওয়াকফ সম্পত্তিকে সরকারি সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি এটিকে একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের সূচনা বলে দাবি করেন। আইনটির আওতায় মুসলিম ধর্মীয় সম্পত্তিকে ধীরে ধীরে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে বলে ওয়াইসির আশঙ্কা।
ওয়াইসি আরও বলেন, তিন তালাক, সিএএ, ইউএপিএ, ইউসিসি— এসবই মুসলিম সমাজের উপর ধারাবাহিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি মনে করিয়ে দেন, যদিও এআইএমআইএম (AIMIM) সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নিয়েছে, তারা সেই রায়গুলোকে অখণ্ড বা নির্ভুল মনে করে না। “আমরা সাংবিধানিক নৈতিকতা মানি বলেই রায়ের প্রতি সম্মান দেখাই। কিন্তু যারা সংবিধান মানে না, তারা কেবল তার নাম ব্যবহার করছে— যেমন করছে আরএসএস,” বলেন তিনি। তিনি বিজেপিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলেন, “যারা ধর্মীয় যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে, তারাই সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।”
এই আইন নিয়ে ওয়াইসির সবচেয়ে জোরালো আপত্তি এসেছে দাউদি বোহরা সম্প্রদায়কে জোর করে আইনের আওতায় আনার বিরুদ্ধে। সংসদের কমিটিতে বোহরা সম্প্রদায় পরিষ্কারভাবে জানিয়েছিল যে তারা এই আইনের আওতায় পড়তে চায় না, এমনকি সংশোধনের প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু মোদি সরকার উল্টো পথে হেঁটে গোটা সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং শুধু কিছু নির্দিষ্ট ট্রাস্টকে ছাড় দিয়েছে। ওয়াইসি হুঁশিয়ারি দেন, সংশোধিত ধারা অনুযায়ী ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানি এখন এই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তির মালিক হয়ে যেতে পারেন। যদিও সুপ্রিম কোর্ট সাময়িক স্থগিতাদেশ দিয়েছে, তবুও ১৯৬৩ সালের লিমিটেশন অ্যাক্টের কারণে বহু সম্পত্তি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই আইনকে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মমর্যাদায় আঘাত বলে উল্লেখ করে ওয়াইসি বলেন, “আত্মমর্যাদা ছাড়া জীবিত দেহও মৃতদেহের মতো। যারা মোদি সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে এই আইনকে সমর্থন করছে, তারা যেন মনে রাখে মৃত্যুর পরে তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে— তারা আল্লাহর অনুসারী ছিলেন, নাকি মোদির।” তিনি মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান এবং ফিলিস্তিনিদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের সংগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার কথা বলেন। অন্য ধর্মাবলম্বীদের দৃষ্টান্ত টেনে ওয়াইসি বোঝান, যেভাবে হিন্দুদের জন্য এন্ডোউমেন্ট অ্যাক্ট বা শিখদের জন্য গুরদোয়ারা কমিটি কাজ করে, তেমনভাবেই ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনাও স্বতন্ত্র নীতিতে হওয়া উচিত।
এই সভার প্রধান অতিথি ছিলেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি। তিনি বলেন, এই আইন বাতিল না হলে শরিয়তের রক্ষাও সম্ভব হবে না। তিনি জানান, নতুন আইনে বলা হয়েছে কেউ যদি ১২ বছর ধরে অবৈধভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি দখলে রাখে, তবে সে সেই সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবে। কিন্তু ওয়াকফে দান করতে গেলে দাতাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে থাকতে হবে— যা আগে ছিল না। মাওলানা রাহমানি তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানান যাতে তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় গঠনমূলক বিতর্ক ও প্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তিকর বার্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
এই আলোচিত সভায় অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআরসিপি, তামিলনাড়ুর ডিএমকে-সহ বহু রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। আয়োজকেরা বলেন, “একটা বালির কণাও যদি ফেলতাম, তা মাটিতে পৌঁছাত না”— এতটাই ভিড় ছিল সেখানে। সভার শেষে ওয়াইসি ও মাওলানা রাহমানি উভয়েই দেশজুড়ে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দেন এবং বলেন, এই আন্দোলনে অমুসলিমদেরও যুক্ত করতে হবে, যাতে বিজেপি সরকারকে গণচাপের মুখে পড়ে বিতর্কিত এই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতে হয়।
ইনকিলাব ডেস্ক/২০ এপ্রিল, ২০২৫