
-
Facebook
-
Twitter
-
Linkedin
সচিব পদবি চান তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও
বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ফের আন্দোলনে নেমেছেন প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাধিক পক্ষ। আওয়ামী সুবিধাভোগী সচিবদের দ্রুত অপসারণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য গঠিত অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন কমিটি বাতিল এবং সচিবালয় নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী সিনিয়র ৪০০ প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) হিসেবে সুপার নিউমারি পদে পদোন্নতি দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। কেবল তাই নয়, দ্বিতীয় শ্রেণির এও, পিও এবং তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও সচিব পদবি চাইছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদবি ‘উপসহকারী সচিব’, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ‘অতিরিক্ত উপসহকারী সচিব’ এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ‘সাচিবিক সহকারী’ করার দাবিতে মাঠে নেমেছেন তারা। অবসরে যাওয়া সাবেক কর্মকর্তারাও বিভিন্ন ব্যানারে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন। বিভিন্ন পক্ষের আন্দোলনে ফের অস্থিরতা শুরু হয়েছে জনপ্রশাসনে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনের মূল কেন্দ্র সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা শুরু হয়। বঞ্চিত দাবি করে কর্মকর্তাদের একটি অংশ আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে বাগিয়ে নেন পদোন্নতি ও ভালো পদায়ন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৯ মাস ধরেই বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ-সমাবেশ বা কোনো কর্মকর্তার অফিস ঘেরাওয়ের ঘটনা লেগেই রয়েছে। নাগরিক সেবা সহজ করা, কাজের গতি বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে তেমন নজর না দিয়ে পদোন্নতি, পদায়নসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্দোলনে ব্যস্ত রয়েছেন কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন পক্ষ। এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার নন-ক্যাডার কর্মচারীদের জন্য অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারি করায় ফের অস্থিরতা শুরু হয়।
অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মাঠে নেমেছেন সচিবালয় এবং বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দফতরের কর্মচারীরা। আওয়ামী সুবিধাভোগী সচিবদের দ্রুত অপসারণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফোরাম এবং অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ এবং বৈষম্যহীন, জনবান্ধব ও কল্যাণমূলক সিভিল সার্ভিস গঠনে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে প্রশাসন বাদে বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। এ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের ঠান্ডা লড়াই চলছে।
এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কলমবিরতি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন মহল থেকে ফ্যাসিস্ট দোসর আখ্যায়িত করে সচিবসহ শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদের নামের তালিকা তৈরি এবং পোস্টারিং করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হচ্ছে। সবমিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন পক্ষ দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামায় প্রশাসনে নতুন করে অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শুরুতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে আন্দোলন করলেও সম্প্রতি সাবেক কর্মকর্তাদেরও দুটি পক্ষ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছেন। সচিবালয়ের ভেতরে তাদের দাপটে বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষও বেড়েছে। আওয়ামী সুবিধাভোগী পাঁচ সচিবকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে সাবেক কর্মকর্তাদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। পাঁচজন সচিবের অপসারণ ও প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবি নিয়ে গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এরফানুল হককে সারা দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন সংগঠনটির নেতারা। সে সময় হেনস্থার শিকার হন ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব জামিলা শবনমও। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এপিডিকে অবরুদ্ধ করে রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণ করে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন, যা কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি। বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের দাবির সঙ্গে একমত হয়ে কর্মসূচি পালন করছে বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফোরামও। সংগঠনটির সভাপতি ড. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, প্রশাসনে ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে সুবিধাভোগী এ সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন তাদের চুক্তি বাতিল করতে হবে। ফ্যাসিবাদীদের দোসররা এখনও প্রশাসনে আছে। বর্তমান জনপ্রশাসন সচিবও তাদের হেয় করেছেন। তাই তাদের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এদিকে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ ছয় দফা দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে। তাদের দাবিগুলো হলো- সচিবালয় নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ ৪০০ প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) হিসেবে সুপার নিউমারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদবি ‘উপসহকারী সচিব’, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ‘অতিরিক্ত উপসহকারী সচিব’ এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ‘সাচিবিক সহকারী’ করা, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য গঠিত অভিন্ন নিয়োগবিধি কমিটি বাতিল করা, সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রেশন সুবিধা এবং সচিবালয় ভাতা ও ৩০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা চালু করা।
সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম জানান, এই দাবিতে তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করেছেন।
অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়নে কমিটি গঠনের বিরোধিতা, পদনাম পরিবর্তন, সচিবালয় রেশন ভাতা চালু, নবম পে-কমিশন গঠন, মহার্ঘ ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েক দিন আগে সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেকটি গ্রুপ। দাবি পূরণ না হলে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিদ্যমান সুযোগ হতে চিরতরে বঞ্চিত করার জন্য সুকৌশলে মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের সঙ্গে একীভূত করে অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠনের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা। সরকার এ কার্যক্রম থেকে বিরত না থাকলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন।
৩০টি অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার কর্মচারীরা তাদের পদনাম বদল করে বেতন গ্রেড উন্নীত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আসা এসব আবেদন সরকার পর্যালোচনা করে অভিন্ন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। অভিন্ন নিয়োগবিধি হলে সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা (পিও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের (এও) মাঠ প্রশাসনেও বদলি করা যাবে। আবার মাঠ প্রশাসনের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে পদায়ন করা যাবে। সরকারের এমন উদ্যোগে ফুঁসে উঠেছেন সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এদিকে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা কঠোর হাতে দমাতে নানা বিধান যুক্ত করে সরকার সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিধানগুলো হলো- কোনো কর্মচারীর কারণে দাফতরিক শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটলে তদন্ত ছাড়া তাকে আট দিনের নোটিসে চাকরিচ্যুত করা এবং কেউ বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাকেও তদন্ত ছাড়া আট দিনের মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে কোনো কর্মচারী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন না। এই সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিশেষ করে যারা গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে বঞ্চিত দাবি করে আন্দোলন করছেন সবার মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান বলেন, সরকারি চাকরি থেকে কাউকে বাধ্যতামূলকভাবে বের করে দেওয়া বা বরখাস্ত করা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। এটি করা হলে চাকরি হারানোর আতঙ্কে স্থবির হয়ে পড়বে প্রশাসন।
সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দাবি আদায়ের নামে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন ও তৎপরতা শুধু সরকারি চাকরিবিধির লঙ্ঘনই নয়, সাধারণ জনগণকে সরকারি সেবাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী কর্মস্থলে অসদাচরণ করলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো কিছু পাওয়ার দাবিতে কোনো কর্মকর্তার দরজায় আঘাত করলে, গলা উঁচিয়ে তার সামনে দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে তা উপস্থাপন করা অসদাচরণের শামিল, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অসদাচরণ মূলত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। চাকরিবিধি অনুযায়ী কাজের প্রতি অবহেলাও একজন সরকারি কর্মচারীর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অফিস সময়ে নিজ দফতরে অনুপস্থিত থেকে নিজের বা সমষ্টিগত দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য যেকোনো মুভমেন্ট কাজের প্রতি অবহেলা বলে বিবেচিত হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে যেকোনো উদ্দেশ্যে সরকারকে চাপে রাখার যেকোনো কৌশলই অপরাধ। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে দফতরে অনুপস্থিত থাকাটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সম্প্রতি যারা এসব কাজে যুক্ত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রফিকুল ইসলাম সবুজ
সময়ের আলো/এমএইচ
২০ মে, ২০২৫