সেই ২০০০ সাল থেকে স্বচ্ছতার সাথে পথচলা...

বিরান নগরীর পথে ঢাকা

ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। বর্তমানে শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকায় সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা এবং লতাগুল্ম টিকে আছে।

বিরান নগরীর পথে ঢাকা। অপরিকল্পিত নগরায়ণে সবুজে ঘেরা শহর এখন অনেকটা বিবর্ণ। সবুজায়নের পরিবর্তে নগরীর বুক চিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দালান। ধ্বংস হয়েছে প্রয়োজনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সবুজায়ন। বছরে বছরে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে ফাঁকা জায়গা। উত্তাপ সহনীয়তা অতিক্রম করে তীব্র তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে পড়েছে ৯০ শতাংশ এলাকা। গাছপালা উজাড়ে অনেকটা মৃত নগরীতে পরিণত হচ্ছে ২ কোটির অধিক মানুষের বসবাসরত এই নগরী।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর পরিবেশ রক্ষায় ঢাকায় ২০ শতাংশ সবুজ এলাকার প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে তা এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। বছরে ৩ বর্গমিটার করে কমছে ফাঁকা জায়গা। উত্তাপ বাড়ছে প্রায় এক শতাংশ করে এলাকায়। অসহনীয় বায়ুদূষণের সাথে তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। এতে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ঢাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে পরিবেশ দূষণও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে নগর সবুজায়ন নীতিমালা ও কৌশলপত্র প্রণয়নের দাবি জানিয়ে পরিবেশবিদরা দেশব্যাপী বৃক্ষ সংরক্ষণে আইন ও ‘মাস্টারপ্ল্যানের’ দাবি তুলেছেন।

২৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৯০ শতাংশ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, যেসব এলাকা একসময় নিচু ভূমি ও জলাশয় ছিল, দ্রুত সেখানে তোলা হয়েছে নানা অবকাঠামো। রাখা হয়নি জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ও বৃক্ষরাজি। দিনে যে পরিমাণ সূর্যের আলো আসে, তা ভবনের গায়ে, ছাদে, পার্শ্ববর্তী রাস্তায় জমে থাকে। সূর্য ডোবার পর জমে থাকা তাপ অল্প অল্প করে ছড়ায়। ফলে ঘরে-বাইরে সমান গরম অনুভূত হচ্ছে।

একই সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় বলা হয়, ১৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫৩ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার। ২৩ সালে তা কমে হয়েছে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ সাত বছরে ফাঁকা জায়গা কমেছে প্রায় ২৪ বর্গমিটার। যা বছরে ৩ বর্গমিটারের বেশি।

অন্য দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। বর্তমানে শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকায় সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা এবং লতাগুল্ম টিকে আছে। মোট বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা মাত্র ৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা বলছে, ৮৯ সাল থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে ঢাকায় আরো ৩৫ শতাংশ এলাকায় উত্তাপ বেড়েছে। অর্থাৎ বছরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে ১ শতাংশের বেশি এলাকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৯ সালে যেখানে ঢাকার ৩০ শতাংশ এলাকা তপ্ত ছিল সেখানে ২০১৪ সালে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ দুই যুগে উত্তাপ ছড়িয়েছে ৩০ শতাংশ এলাকায়। যা এখনো অব্যাহত আছে।

অন্য দিকে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। এ ছাড়া বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, ভয়াবহ যানজট, পয়ঃনিষ্কাশনের করুণ অবস্থা, জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের করুণ দশা পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। এতে করে কয়েক বছর ধরে বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে বারবার উঠে আসছে ঢাকার নাম। শব্দদূষণেও রয়েছে শীর্ষে। বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায়ও ঢাকার অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সিটি করপোরেশন গাছ লাগায়, পানিও দেয়। এগুলো হচ্ছে গাছের বাণিজ্য। না হলে ১৫ বছরের গাছ কেটে বাগানবিলাস চারা কেন লাগানো হবে? তিনি বলেন, বড় শহর, সিটি করপোরেশন, পৌর এলাকাসহ সারা দেশে বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য আইন ও মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া এর সমাধান অসম্ভব।

অন্য দিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব জানান, কয়েক বছর থেকে গ্রামের চেয়ে ঢাকা শহরে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা পরিমাপ করা যাচ্ছে। অনুভব কিন্তু তার চেয়েও বেশি। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে গরম অনুভূত হয় বেশি। ছায়া ছাড়া এই প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য সবুজায়ন বৃদ্ধি বেশি জরুরি।

নগরের পরিবেশ নিয়ে নিয়মিত গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান জানান, ২০২৩ সালের তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশে। যদিও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা।

তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কংক্রিট, যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে। এর সাথে বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব। এজন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় তাপমাত্রা কমাতে নতুন ওয়ার্ডগুলোতে প্রচুর গাছ লাগানো দরকার।

আবুল কালাম
নয়াদিগন্ত/১৮ মে ২০২৫

আরও - জাতীয় সংবাদ

আরও - জেলা সংবাদ